দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করি। বিভিন্ন মাধ্যমে এই যোগাযোগ সম্পন্ন হয়। মাধ্যম অনুযায়ী যোগাযোগের উপকরণও নানা রকম হয়।
নিচে যোগাযোগের তিনটি মাধ্যম দেখানো হলো। তুমি কী উদ্দেশ্যে, কার সঙ্গে এ ধরনের যোগাযোগ করে থাকো, তার একটি করে উদাহরণ দাও।
যোগাযোগের মাধ্যম | যেভাবে যোগাযোগ করা হয় | কী উদ্দেশ্যে, কার সঙ্গে যোগাযোগ করি |
---|---|---|
প্রত্যক্ষ মাধ্যম | যখন কারো সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা হয় | |
লিখিত মাধ্যম | যখন লিখে যোগাযোগ করা হয় | |
যান্ত্রিক মাধ্যম | যখন যোগাযোগে যন্ত্রের ব্যবহার হয় |
নিচে যোগাযোগের মাধ্যম এবং এই মাধ্যমে যেসব উপকরণের ব্যবহার হয়, তা দেখানো হলো। এর মধ্যে যেসব উপকরণ তুমি ব্যবহার করো, তা ডানের কলামে লেখো।
যোগাযোগের মাধ্যম | যোগাযোগের উপকরণ | কোন কোন উপকরণ ব্যবহার করি |
---|---|---|
প্রত্যক্ষ মাধ্যম | বাপ্রত্যঙ্গ, কান, হাত, আঙুল, চোখ, ইশারা, সংকেত | |
লিখিত মাধ্যম | কাগজ, কলম, পেনসিল, বই, ব্ল্যাকবোর্ড, হোয়াইটবোর্ড, পত্রিকা, দেয়ালপত্রিকা, ছবি | |
যান্ত্রিক মাধ্যম | মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মাইক্রোফোন, লাউডস্পিকার, মাইক, হেডফোন, রেডিও, টেলিভিশন, অডিও রেকর্ডার, ক্যামেরা, স্ক্যানার |
যোগাযোগ মানেই দুই জন বা আরো বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে ভাব বিনিময়ের একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় আমরা প্রধানত দুটি কাজ করি: নিজের চিন্তা-অনুভূতি-চাহিদা প্রকাশ করি এবং অন্যের চিন্তা-অনুভূতি-চাহিদা বোঝার চেষ্টা করি। এসব কাজের জন্য আমরা যেসব উপায় অবলম্বন করি, সেগুলোকে বলে যোগাযোগের মাধ্যম। নিচে যোগাযোগের তিনটি মাধ্যম উল্লেখ করা হলো:
১. প্রত্যক্ষ মাধ্যম: প্রত্যক্ষ মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক পক্ষ বলে এবং অন্য পক্ষ শোনে। এক্ষেত্রে গলার স্বর, কথার সুর, ইশারা, অঙ্গভঙ্গি, তাকানোর ধরন ইত্যাদি দিকগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
২. লিখিত মাধ্যম: লিখিত মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে লেখা ও পড়ার কাজটিই মুখ্য। এ ধরনের যোগাযোগের নমুনা: চিঠিপত্র, সাহিত্য, নোটিশ, ব্যানার, মোড়ক, বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞপ্তি, পোস্টার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, সাইনবোর্ড, প্রতিবেদন, অ্যাসাইনমেন্ট, পত্রপত্রিকা, ছবি ইত্যাদি।
৩. যান্ত্রিক মাধ্যম: যান্ত্রিক মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার হয়। এ ধরনের যোগাযোগের নমুনা: এসএমএস, ই-মেইল, অনলাইন মিটিং, অডিও-ভিডিও কল, সিনেমা ইত্যাদি।
কখনো আমরা শুধু একটি মাধ্যমে যোগাযোগ করি, কখনো একইসঙ্গে একাধিক মাধ্যম ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। যেমন, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে যোগাযোগের সময়ে একইসঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ এবং লিখিত যোগাযোগ-দুটি মাধ্যমই ব্যবহার করা হয়।
যোগাযোগ করার সময়ে আমরা নানা ধরনের উপকরণ ব্যবহার করি। যেমন:
১. প্রত্যক্ষ উপকরণ: সরাসরি কথা বলার সময়ে বা প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেসব উপকরণ ব্যবহৃত হয়; যেমন-বাপ্রত্যঙ্গ, কান, হাত, আঙুল, চোখ, ইশারা, সংকেত ইত্যাদি।
২. লিখিত উপকরণ: লিখে ভাব প্রকাশের সময়ে বা লিখিত যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেসব উপকরণ ব্যবহৃত হয়; যেমন-কাগজ, কলম, পেনসিল, বই, পত্রিকা, দেয়াল পত্রিকা, ব্ল্যাকবোর্ড, হোয়াইটবোর্ড, ছবি ইত্যাদি।
৩. যান্ত্রিক উপকরণ: যোগাযোগে যেসব যন্ত্র ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়; যেমন-মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মাইক্রোফোন, লাউডস্পিকার, মাইক, হেডফোন, রেডিও, টেলিভিশন, অডিও রেকর্ডার, ক্যামেরা, স্ক্যানার ইত্যাদি।
নিচে কয়েকটি যোগাযোগের নমুনা দেওয়া হলো। নমুনাগুলোয় যেসব মাধ্যম ও উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখো এবং নমুনার শেষে দেওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও। কাজ শেষে সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে উত্তর সংশোধন করো।
নমুনা ১
প্রেক্ষাপট: শ্রেণিকক্ষে ক্লাস চলছে।
কোন মাধ্যমে এখানে যোগাযোগ করা হয়েছে? | |
যোগাযোগে কী কী উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে? | |
এই যোগাযোগের উদ্দেশ্য কী? | |
এই যোগাযোগে আর কোন মাধ্যম ও কী কী উপকরণ ব্যবহার করা যেত? |
নমুনা ২
কনকসার উচ্চ বিদ্যালয় নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এজন্য তারা নিচের আমন্ত্রণপত্রটি তৈরি করেছে।
নজরুল জয়ন্তী ১৪৩১ সুধী আগামী ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৫শে মে ২০২৪, শনিবার সকাল ১০টায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কনকসার উচ্চ বিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে একটি আলোচনা-সন্ধা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আজমল বারি। 'নজরুল কেন এখনো প্রাসঙ্গিক' এই শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন নজরুল গবেষক ড. দীনেশ সাহা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব নাজনিন সুলতানা। অনুষ্ঠানে আপনার উপস্থিতি আন্তরিকভাবে কামনা করি। রাইসুল হোসেন সম্পাদক, সংস্কৃতি সংসদ কনকসার উচ্চ বিদ্যালয়। অনুষ্ঠানসূচি ১০:০০: অতিথিদের আসন গ্রহণ। ১০:০৫: 'নজরুল কেন এখনো প্রাসঙ্গিক' শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ ১০:৩০: প্রধান অতিথির বক্তব্য ১০:৪৫: সভাপতির ভাষণ ১১:০০: সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান |
কোন মাধ্যমে এখানে যোগাযোগ করা হয়েছে? | |
যোগাযোগে কী কী উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে? | |
এই যোগাযোগের উদ্দেশ্য কী? | |
এই যোগাযোগে আর কোন মাধ্যম ও কী কী উপকরণ। ব্যবহার করা যেত? |
নমুনা ৩
কাহারগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক জিনাত শারমিন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য একটি দলীয় অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন। অ্যাসাইনমেন্টটি ইমেইলের মাধ্যমে জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এভাবে ইমেইল পাঠিয়েছে
প্রতি: jinat05 kaharganj@gmail.com শ্রদ্ধেয় ম্যাডাম, শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছাসহ- |
কোন মাধ্যমে এখানে যোগাযোগ করা হয়েছে? | |
যোগাযোগে কী কী উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে? | |
এই যোগাযোগের উদ্দেশ্য কী? | |
এই যোগাযোগে আর কোন মাধ্যম ও কী কী উপকরণ ব্যবহার করা যেত? |
নমুনা ৪
প্রেক্ষাপট: রায়হান সাহেব একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন। তাঁর অফিসে জরুরি মিটিং চলছে। একজন সহকর্মী অনলাইনে মিটিংয়ে যুক্ত হয়েছেন।
কোন মাধ্যমে এখানে যোগাযোগ করা হয়েছে? | |
যোগাযোগে কী কী উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে? | |
এই যোগাযোগের উদ্দেশ্য কী? | |
এই যোগাযোগে আর কোন মাধ্যম ও কী কী উপকরণ ব্যবহার করা যেত? |
নমুনা ৫
যোগাযোগের একটি বিশেষ ধরনের মাধ্যম হলো সাহিত্য। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে লেখকের সঙ্গে পাঠকের যোগাযোগ ঘটে। এটি একটি লিখিত যোগাযোগ।
নিচে হুমায়ুন আহমেদের (১৯৪৮-২০১২) লেখা একটি সাহিত্য-নমুনা দেওয়া হলো। লেখাটি তাঁর 'আগুনের পরশমণি' উপন্যাসের অংশবিশেষ। হুমায়ুন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে 'নন্দিত নরকে', 'শঙ্খনীল কারাগার', 'জোছনা ও জননীর গল্প' ইত্যাদি।
হুমায়ুন আহমেদ
ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজে। কার্টু শুরু হতে এখনো আধ ঘন্টা বাকি। কিন্তু এর মধ্যেই চারদিক জনশূন্য। লোকজন যার যার বাড়ি ফিরে গেছে। বাকি রাতটায় কেউ আর ঘর থেকে বেরুবে না। ইদ্রিস মিয়া তার দোকান বন্ধ করার জন্যে উঠে দাঁড়াল। রোজ শেষ মুহূর্তে কিছু বিক্রিবাটা হয়। আজ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না কে জানে?
অন্ধকার দেখে সবাই ভাবছে বোধ হয় কার্টুর সময় হয়েছে। সময় না হলেও কিছু যায় আসে না। আজকাল সবাই অন্ধকারকে ভয় পায়। ইদ্রিস মিয়া দোকানের তালা লাগাবার সময়ে লক্ষ করল গলির ভেতরে লম্বা একটি ছেলে ঢুকছে। তার হাতে কয়েকটা পত্রিকা। হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বাসার নম্বর পড়তে পড়তে আসছে। ইদ্রিস মিয়ার দোকানের সামনে এসে সে থমকে দাঁড়াল। ইদ্রিস মিয়া বলল, 'আপনি কি মতিন সাবের বাড়ি খুঁজেন?'
ছেলেটি তাকাল বিস্মিত হয়ে। কিছু বলল না। ইদ্রিস বাড়ি দেখিয়ে দিল। নিচু গলায় বলল-
: লোহার গেইট আছে। গেইটের কাছে একটা নাইরকল গাছ। তাড়াতাড়ি যান। ছয়টার সময় কার্টু।
ইদ্রিস মিয়া হন হন করে হাঁটতে লাগল। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। ছেলেটি তাকিয়ে রইল ইদ্রিস মিয়ার দিকে। লোকটি ছোটোখাটো। প্রায় দৌড়াচ্ছে। সে নিশ্চয়ই অনেকখানি দূরে থাকে। ছটার আগে তাকে পৌঁছতে হবে।
ছেলেটি এগিয়ে গেল। লোহার গেটের বাড়িটির সামনে দাঁড়াল। নারকেল গাছ দুটি ঝুঁকে আছে রাস্তার দিকে। প্রচুর নারকেল হয়েছে। ফলের ভারেই যেন গাছ হেলে আছে। দেখতে বড়ো ভালো লাগে। ছেলেটি গেটে ঢোকা দিয়ে ভারী গলায় ডাকল, 'মতিন সাহেব, মতিনউদ্দিন সাহেব।' বয়সের তুলনায় তার গলা ভারী। ছেলেটির নাম বদিউল আলম। তিন মাস পর সে এই প্রথম ঢুকেছে ঢাকা শহরে।
জুলাই মাসের ২ তারিখ। বুধবার। উনিশশো একাত্তর সন। একটি ভয়াবহ বৎসর। পাকিস্তানি সৈনাবাহিনীর কঠিন মুঠির ভেতরে একটি অসহায় শহর। শহরের অসহায় মানুষ। চারদিকে সীমাহীন অন্ধকার। সীমাহীন ক্লান্তি। দীর্ঘ দিবস এবং দীর্ঘ রজনী।
বদিউল আলম গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে শহরে ঢুকেছে সাতজনের একটি ছোট্ট দল নিয়ে। শহরে গেরিলা অপারেশন চালানোর দায়িত্ব তার। ছেলেটি রোগা। চশমায় ঢাকা বড়ো বড়ো চোখ। গায়ে হালকা নীল রঙের হাওয়াই শার্ট। সে একটি রুমাল বের করে কপাল মুছে দ্বিতীয়বার ডাকল, 'মতিন সাহেব, মতিন সাহেব।'
মতিন সাহেব দরজা খুলে বের হলেন। দীর্ঘ সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছেলেটির দিকে। এ তো নিতান্তই বাচ্চা ছেলে। এরই কি আসার কথা?
: আমার নাম বদিউল আলম।
: এসো বাবা, ভেতরে এসো।
সামান্য কথা বলতে গিয়ে মতিন সাহেবের গলা ধরে গেল। চোখ ভিজে উঠল। এত আনন্দ হচ্ছে। তিনি চাপা স্বরে বললেন, 'কেমন আছ তুমি?'
: ভালো আছি।
: সঙ্গে জিনিসপত্র কিছু নেই?
: না।
: বলো কি!
সুরমা দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। পর্দা সরিয়ে তাকিয়ে আছেন। মতিন সাহেব বললেন, ‘এসো, ভেতরে বসো। দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
: গেটটা বন্ধ। গেট খুলুন।
: ও আচ্ছা আচ্ছা।
মতিন সাহেব সংকুচিত হয়ে পড়লেন। সাড়ে পাঁচটার দিকে গেটে তালা দিয়ে দেয়া হয়। চাবি থাকে সুরমার কাছে। সুরমা আঁচল থেকে চাবি বের করলেন।
: গেটে তালা দিয়ে রাখি। আগে দিতাম না। এখন দেই। অবশ্যি চুরি-ডাকাতির ভয়ে না। চুরি-ডাকাতি কমে গেছে। চোর-ডাকাতরা এখন কীভাবে বেঁচে আছে কে জানে। বোধ হয় কষ্টে আছে।
বদিউল আলম বসবার ঘরে ঢুকল। মতিন সাহেবের মনে হলো এই ছেলেটির কোনো দিকেই কোনো উৎসাহ নেই। সোফাতে বসে আছে কিন্তু কোনো কিছু দেখছে না। বসার ভঙ্গির মধ্যেই গা ছেড়ে দেয়া ভাব আছে। মতিন সাহেব নিজের মনে কথা বলে যেতে লাগলেন-
: কয়েকদিন ধরে আমরা স্বামী-স্ত্রী আছি। এই বাড়িতে। আমাদের দুই মেয়ে আছে-রাত্রি আর অপালা। ওরা তার ফুফুর বাড়িতে। সোমবার আসবে। ওদের ফুফু, মানে আমার বোনের কোনো ছেলেপুলে নেই। মাঝেমধ্যে রাত্রি আর অপালাকে নিয়ে যায়। ওরাও তাদের ফুফুর খুব ভক্ত। খুবই ভক্ত।
বদিউল আলম কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল। মতিন সাহেব খানিকটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। গলা পরিষ্কার করে বললেন-অবস্থা কী বলো শুনি।
: কিসের অবস্থা?
: তোমরা যেখানে ছিলে সেখানকার অবস্থা।
: ভালোই।
: আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাঘের পেটের ভেতর আছি। কাজেই বাধটা কী করছে না করছে বোঝার উপায় নেই। বাঘ মারা না পড়া পর্যন্ত কিছুই বুঝব না। মারা পড়ার পরই পেট থেকে বের হব
মতিন সাহেবের এটা একটা ভিন্ন ডায়ালগ। সুযোগ পেলেই এটা ব্যবহার করেন। শ্রোতারা তখন বেশ উৎসাহী হয়ে তাকায়। কয়েকজন বলেই ফেলে-ভালো বলেছেন। কিন্তু এবারে সে রকম কিছু হলো না। মতিন সাহেবের ভয় হলো ছেলেটা হয়তো শুনছেই না।
: তুমি হাত মুখ ধুয়ে এসো। চায়ের ব্যবস্থা করছি।
: চা খাব না। ভাতের ব্যবস্থা করুন, যদি অসুবিধে না হয়।
: না না, অসুবিধে কিসের? কোনো অসুবিধে নেই। খাবার-টাবার গরম করতে বলে দিই।
: গরম করবার দরকার নেই। যেমন আছে দিন।
মতিন সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে উঠে গেলেন। একজন ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে বকবক করছিলেন। খুব অন্যায়। খুবই অন্যায়।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটির প্রসঙ্গে সুরমা কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। যেন দেখবার পর তাঁর সব কৌতূহল মিটে গেছে। ভাত খাওয়ার সময়ে নিজেই দু-একটা কথা বললেন। যেমন একবার বললেন, 'তুমি মনে হচ্ছে ঝাল কম খাও।' ছেলেটি তার জবাবে অন্য এক রকম ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। দ্বিতীয় বারে বললেন, 'ছোটো মাছ তুমি খেতে পারছ না দেখি। আস্তে আস্তে খাও, আমি একটা ডিম ভেজে নিয়ে আসি।'
ছেলেটি এই কথায় খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইল। ভাজা ডিমের জন্য প্রতীক্ষা। ব্যাপারটা মতিন সাহেবের বেশ মজার মনে হলো। সাধারণত এই পরিস্থিতিতে সবাই বলে-না না লাগবে না। লাগবে না।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই বদিউল আলম বলল, 'আমাকে শোবার জায়গা দেখিয়ে দিন।' মতিন সাহেব বললেন, 'এখুনি শোবে কি? বসো, কথাবার্তা বলি। স্বাধীন বাংলা বেতার শুনবে না?'
: জি না। স্বাধীন বাংলা বেতার শুনবার আমার কোনো অগ্রহ নেই।
: বলো কি তুমি! কখনো শোনো না?
: শুনেছি মাঝে মাঝে।
তিনি খুবই ক্ষুণ্ণ হলেন। ছেলেটি স্বাধীন বাংলা বেতার শোনে না সে কারণে নয়। ছেলেটি দুবার কথার মধ্যে তাঁকে বলেছে মতিন সাহেব। এ কি কান্ড: চাচা বলবে। যদি বলতে খারাপই লাগে, কিছু বলবে না। কিন্তু মতিন সাহেব বলবে কেন? তিনি কি তার ইয়ার দোস্তদের কেউ? এ কেমন ব্যবহার?
ঘর ঠিকঠাক করলেন সুরমা। রাত্রি ও অপালার পাশের ছোটো ঘরটায় ব্যবস্থা হলো। বিপ্তির ঘর। বিত্তি ঘুমবে বারান্দায়। এ ঘরটা ভাঁড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরিষ্কার করতে সময় লাগল। তবু পুরোপুরি পরিষ্কার হলো না। চৌকির নিচে রসুন ও পেঁয়াজ। বস্তায় ভর্তি চাল-ডাল। এসব থেকে কেমন একটা টক টক গন্ধ ছড়াচ্ছে। সুরমা বললেন, 'তুমি এ ঘরে ঘুমতে পারবে তো? না পারলে বলো, আমি বসার ঘরে ব্যবস্থা করে দিই। একটা ক্যাম্পযাট আছে, পেতে দেবো?
: লাগবে না।
: বাথরুম কোথায় দেখে যাও।
বদিউল আলম বাথরুম দেখে এলো।
: কোনো কিছুর দরকার হলে আমাকে ডাকবে।
আমার কোনো কিছুর দরকার হবে না।
সুরমা চৌকির এক প্রান্তে বসলেন। বসার ভঙ্গিটা কঠিন। বদিউল আলম কৌতূহলী হয়ে তাঁকে দেখল।
: আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?
: হ্যাঁ
: বলুন।
: তুমি কে আমি জানি না। কোথেকে এসেছ তাও জানি না। কিন্তু কী জন্যে এসেছ তা আন্দাজ করতে পারি।
: আন্দাজ করবার দরকার নেই। আমি বলছি কী জন্যে এসেছি। আপনাকে বলতে আমার কোনো অসুবিধে নেই।
: তোমার কিছু বলার দরকার নেই। আমি তোমাকে কী বলছি সেটা মন দিয়ে শোনো।
: বলুন।
: তুমি সকালে উঠে এখান থেকে চলে যাবে।
: ছেলেটি কিছু বলল না। তাঁর দিকে তাকালও না।
: দুটি মেয়ে নিয়ে আমি এখানে থাকি, কোনো রকম ঝামেলার মধ্যে আমি জড়াতে চাই না। রাত্রির বাবা আমাকে না জিজ্ঞেস করে এসব করেছে। তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাচ্ছি?
:পারছি
: তুমি কাল সকালে চলে যাবে।
: কাল সকালে যাওয়া সম্ভব না। সব কিছু আগে থেকে ঠিকঠাক করা। মাঝখান থেকে হুট করে কিছু বদলানো যাবে না। আমি এক সপ্তাহ এখানে থাকব। আমার সঙ্গে যারা যোগাযোগ করবে তারা এই ঠিকানাই জানে। সুরমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কী রকম উচ্চত ভঙ্গিতে সে কথা বলছে। এ কি কান্ড!
: তোমার জন্যে আমি আবার মেয়েগুলোকে নিয়ে বিপদে পড়ব? এসব তুমি কী বলছ?
: বিপদে পড়বেন কেন? বিপদে পড়বেন না। এক সপ্তাহের মধ্যে আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে। এর পরের বার আমি এখানে উঠব না। আর আপনার মেয়েরা তাদের ফুফুর বাড়িতে থাকুক। এক সপ্তাহ পর আসবে।
: তুমি থাকবেই?
: হ্যাঁ। অবশ্যি আপনি যদি ভয় দেখান আমাকে ধরিয়ে দেবেন, সেটা অন্য কথা। তা দেবেন না। সেটা বুঝতে পারছি।
সুরমা উঠে দাঁড়ালেন। যে ছেলেটিকে এতক্ষণ লাজুক এবং বিনীত মনে হচ্ছিল, এখন তাকে দুর্বিনীত অভদ্র একটি ছেলের মতো লাগছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ছেলেটির এই রূপটিই তার ভালো লাগল। কেন লাগল তিনি বুঝতে পারলেন না।
: আলম।
বলুন্
: ঢাকা শহরে কি তোমার বাবা-মারা থাকেন?
: হ্যাঁ থাকেন।
: কোথায় থাকেন?
: শহরেই থাকেন।
: বলতে কি তোমার অসুবিধা আছে?
: হ্যাঁ আছে।
: তুমি এক সপ্তাহ থাকবে?
হ্যাঁ
সুরমা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। ঘন অন্ধকারে নগরী ডুবে গেল। ঝুম বৃষ্টি নামল।
কার্ফু: কারফিউ; বাড়ির বাইরে বের না হওয়ার সরকারি নির্দেশ।
ঝুম বৃষ্টি: প্রবল বৃষ্টি।
ক্যাম্পখাট: কাঠ ও মোটা কাপড়ে তৈরি ঘাট।
গেরিলা অপারেশন: নিজেকে গোপন করে শত্রুকে ঘায়েল করার যুদ্ধ।
তায়ালগ: সংলাপ।
বিক্রিবাটা: বেচাকেনা।
স্বাধীন বাংলা বেকার: মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পরিচালিত বাংলাদেশের বেতারকেন্দ্র।
'আগুনের পরশমণি' সাহিত্য-নমুনার ভিত্তিতে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
কোন মাধ্যমে এখানে যোগাযোগ করা হয়েছে? এই মাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যনের তফাত কী? | |
এই যোগাযোগে কী কী উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে? একজন লেখক লেখার সময়ে কী কী উপকরণ ব্যবহার করেন এবং একজন প্রকাশক প্রকাশের সময়ে কী কী উপকরণ ব্যবহার করে থাকেন? | |
এই যোগাযোগের উদ্দেশ্য কী? উপরের সাহিত্য-নমুনায় লেখক কী ধরনের অভিজ্ঞতা পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন? | |
এই যোগাযোগে আর কোন কোন মাধ্যম ও কী কী উপকরণ ব্যবহার করা যেত? ভিডিও মাধ্যমে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন কী কী উপকরণের প্রয়োজন হবে? |
দলে ভাগ হও। প্রত্যেক দল আলাদা আলাদাভাবে বিদ্যালয়ের বা এলাকার কোনো একটি সমস্যা চিহ্নিত করো। সমস্যাটি সমাধানের জন্য কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং কোন মাধ্যমে ও কী কী উপকরণ ব্যবহার করে যোগাযোগ করতে হবে, তা আলোচনা করে ঠিক করো। এরপর যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করো। নিচে কিছু নমুনা বিষয় দেওয়া হলো।
বিদ্যালয়ের সমস্যা:
এলাকার সমস্যাঃ